যীশু সেন, বিশেষ প্রতিনিধি :
চট্টগ্রামের সংগীতচর্চার ঐতিহ্যবাহী ধারাকে এগিয়ে নিতে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছে বাগীশ্বরী সংগীতালয়। সেই ধারাবাহিকতায় গত ৪ সেপ্টেম্বর, বৃহস্পতিবার, সন্ধ্যা ৬ টায় আন্দরকিল্লাস্থ বাগীশিক মিলনায়তনে আয়োজিত হয় প্রতিষ্ঠানটির চতুর্মাসিক উচ্চাঙ্গ সংগীতানুষ্ঠান। উচ্চাঙ্গ সংগীতের গাম্ভীর্য ও শুদ্ধতাকে কেন্দ্র করে আয়োজিত এই মননশীল সন্ধ্যা একদিকে যেমন শ্রোতাদের কাছে হয়ে ওঠে এক অতুলনীয় শ্রবণানুভূতি, তেমনি শিল্পী ও সংগঠকদের জন্য ছিল সাধনার এক উন্মোচিত পরিসর।অনুষ্ঠানের উদ্বোধনেই পরিলক্ষিত হয় এক সাংস্কৃতিক সৌন্দর্য ও সংগীতানুরাগের বন্ধন। অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আর্য্য সংগীত সমিতির উপাধ্যক্ষ অধ্যাপিকা মৃণালিনী চক্রবর্তী, যিনি বলেন, “উচ্চাঙ্গ সংগীত কেবল গান নয়—এ এক ধ্যান, এক আত্মিক সাধনা। বাগীশ্বরীর এই প্রয়াস আমাদের নতুন প্রজন্মের মাঝে সেই সাধনার বীজ বপন করছে।”
সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও শিল্পপতি রিয়াজ ওয়ায়েজ। তিনি বলেন, “এই রকম অনুষ্ঠানগুলো শুধুমাত্র সংগীত পরিবেশনার আয়োজন নয়, বরং এক সাংস্কৃতিক দায়িত্ব পালন—যা সমাজ ও প্রজন্মকে শুদ্ধ সংগীতচর্চার দিকে উৎসাহিত করে।”
বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক পরিষদের কেন্দ্রীয় মহাসচিব ডা. অঞ্জন কুমার দাশ।
অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন বাগীশ্বরী সংগীতালয়ের সহ-সভাপতি অধ্যাপিকা ঊর্মিলা রাণী ভৌমিক। তাঁর বক্তব্যে ফুটে ওঠে সংগঠনের দীর্ঘদিনের পরিশ্রম, স্বপ্ন ও আগামীদিনের দিকনির্দেশনা।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই সংগীতালয়ের অধ্যক্ষ রিষু তালুকদার তাঁর স্বাগত বক্তব্যে বলেন, “এই সংগীতানুষ্ঠান কেবল একটি সাংস্কৃতিক আয়োজন নয়, এটি একটি আত্মিক চর্চা, যা সংগীতপ্রেমীদের সঙ্গে শিল্পীদের একটি গভীর সংযোগ স্থাপন করে।”
শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন যুগ্ম সম্পাদক সাংবাদিক যীশু সেন, যিনি বলেন, “উচ্চাঙ্গ সংগীতকে আধুনিক প্রজন্মের কাছে সহজবোধ্য ও আগ্রহজনক করে তোলা এখন সময়ের দাবি। বাগীশ্বরী তার প্রতিটি পদক্ষেপে সেই চেষ্টাই করে চলেছে।”
অনুষ্ঠান উদযাপন পরিষদের পক্ষ থেকে সমন্বয়ক ব্যাংকার উৎপল চক্রবর্তী, আহ্বায়ক ডা. সৌমিত্র দাশ এবং সদস্য সচিব প্রভাষক ঝুমুর খাস্তগীর, প্রকৌশলী রিমন সাহা, তাঁদের বক্তব্যে আয়োজনের নানান দিক তুলে ধরেন এবং আগামী দিনে এই ধারা আরও সম্প্রসারিত করার আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
সার্বিক সঞ্চালনায় ছিলেন বাচিক শিল্পী অদিতি সাহা , যিনি মার্জিত, সুসংহত এবং শ্রোতাবান্ধব উপস্থাপনায় অনুষ্ঠানকে প্রাণবন্ত করে তোলেন। উচ্চাঙ্গ সংগীত পরিচালনায় ছিলেন অধ্যক্ষ রিষু তালুকদার।
অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ ছিল উচ্চাঙ্গ সংগীত পরিবেশনা, যা শুরু হয় বাগীশ্বরী সংগীতালয়ের শিল্পীদের ধ্রুপদ সমবেত পরিবেশনা দিয়ে। তাঁদের কণ্ঠে ভূপালী রাগ-তাল-লয়ের নিখুঁত সংমিশ্রণে মিলনায়তনে তৈরি হয় এক অতুলনীয় রসিক পরিবেশ। শ্রোতাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এক মোহময় প্রশান্তি। এরপর একে একে মঞ্চে আসেন বিশিষ্ট শিল্পীরা—
তবলা লহড়া পরিবেশনায় ছিলেন শিল্পী দেবজিৎ চৌধুরী দেবু, হারমোনিয়ামে-দীপ্ত দে। তাঁর তালের ভাঁজে ভাঁজে উচ্চাঙ্গ সংগীতের ছন্দমাধুর্য যেন নতুনভাবে ফুটে ওঠে।
কণ্ঠ পরিবেশনায় ছিলেন শিল্পী মৌমিতা বিশ্বাস ও প্রিয়ন্তী দাশ। তাঁদের যুগল পরিবেশনায় ছিল রাগ-আহির ভৈরব। উচ্চাঙ্গ সংগীতের পরিমিত অনুশীলনের নিদর্শন। রাগের নিখুঁত উপস্থাপনায় শ্রোতাদের মধ্যে তৈরি হয় এক অন্তরঙ্গ সুরশ্রুতি। শিল্পী স্নিগ্ধা দে ও হিমাদ্রি গুহ-এর যুগল কণ্ঠে পরিবেশিত রাগ-দেশ। পরিবেশনায় গভীরতা ও অনুভূতির ছাপ ছিল স্পষ্ট।
তবলা সঙ্গত করেন শিল্পী পলাশ দে ও সৌমেন দাশ, যাঁদের নিখুঁত বোল, সংগত এবং লয়ের দক্ষতায় মূল গান আরও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। আবৃত্তি পরিবেশন করেন মৌবনী সেনগুপ্তা।
ধ্রুপদ পরিবেশনায় শিল্পীবৃন্দ হলেন- ডা. সৌমিত্র দাশ, ঝুমুর খাস্তগীর, রিমন সাহা, বৃষ্টি চক্রবর্তী, সজীব চৌধুরী, নয়ন গুহ, অদ্রি সেন, অর্পিতা দাস, অর্জুন তালুকদার, অংকিতা সেন, সুইটি বর্মন, প্রিয়ন্ত দাশগুপ্ত, অমৃত চক্রবর্তী, নিকিতা বিশ্বাংগ্রী, নীলাদ্রি চক্রবর্তী, লাবনী দত্ত, অরিত্র দে, সেগিত দাশ, আঁখি বড়ুয়া, প্রিয়ন্তী দাশ পূর্বা,পারমিতা চৌধুরী, আরাধ্যা চক্রবতী, মেবিনী সেনগুপ্তা, পুনম দাশ, অনিন্দিতা চৌধুরী, অদ্রিজা চৌধুরী, সুস্তিকা মজুমদার, সৌমিক দাশ প্রমূখ। প্রতিটি পরিবেশনায় ছিল এক স্বতঃস্ফূর্ত শিল্পনৈপুণ্য—যেখানে শিল্পীরা তাঁদের একাগ্রতা, নিষ্ঠা ও রাগানুরাগের মাধ্যমে উচ্চাঙ্গ সংগীতের শুদ্ধতা তুলে ধরেন।
অনুষ্ঠানের শেষে উপস্থিত শ্রোতামণ্ডলীকে ধন্যবাদ জানানো হয় এবং শিল্পী ও অতিথিদের স্মারক উপহার প্রদান করা হয়। পুরো অনুষ্ঠানজুড়ে শ্রোতাদের প্রশান্তি, মনোযোগী ও রসগ্রাহী উপস্থিতি প্রমাণ করে—উচ্চাঙ্গ সংগীতের প্রতি মানুষের আগ্রহ এখনও অম্লান।এই চতুর্মাসিক উচ্চাঙ্গ সংগীতানুষ্ঠান কেবল সংগীত পরিবেশনার এক আঙ্গিক নয়, এটি এক সাংস্কৃতিক অঙ্গীকার, যা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য শুদ্ধ সংগীতচর্চার পথকে সুগম করে তুলবে—এমনটাই প্রত্যাশা করেন আয়োজক ও শিল্পীসমাজ।
প্রধান সম্পাদক প্রদীপ শীল - ব্যবস্থাপনা সম্পাদক মোহাম্মদ আলাউদ্দীন।